এক দুপুরে গনভবনে গেলাম। বঙ্গবন্ধু খাওয়ার টেবিলে ডেকে নিলেন। খেতে বসে বললেন, 'বাকশাল সম্পর্কে তোমার মনে আপত্তি আছে, তা আমি জানি।'
আমি বললাম, 'বাকশাল সম্পর্কে আমার মনে কোনো আপত্তি নেই। তবে এই পদ্ধতি প্রবর্তনের সময়টা সঠিক হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।'
বঙ্গবন্ধু বললেন, 'সঠিক, কি বেঠিক হয়েছে, তা আমি জানি না। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা'র ভিত্তি গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কে রক্ষা করার জন্য এ পথে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। গনতন্ত্রের দুর্বলতার ফাঁকফোকরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এমনভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছে ও বাংলাদেশকে নামে বাংলাদেশ রেখে আরেকটি পাকিস্তানে পরিনত করার চক্রান্ত শক্তিশালী করে তুলছে, যা মোকাবিলা করতে হলে বাকশাল পদ্ধতি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ আমার সামনে খোলা নেই।
আমি যদি ব্যর্থ হই, তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বাংলাদেশে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তুলবে এবং আমার সামরিক বাহিনীর পাকিস্তানিমনা অংশ তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি ধ্বংস করবে।'
এর পর তিনি ইংরেজীতে বললেন,
'I have created a history. I am trying to protect it from enemy with in and outside. If I fail, I will go to oblivion for a long time '
বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, 'আমি একটি ইতিহাস তৈরী করেছি। যেটা রক্ষা করার চেষ্টা করছি ভেতরের ও বাইরের শত্রুদের কাছ থেকে। আমি যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমাকে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যেতে হবে।'
তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে, তিনি আমার হাত ধরে বললেন, 'আমি মানুষ, ফেরেস্তা নই। আমার কোনো কোনো কাজে ভুলত্রুটি হতেই পারে। তোমরা যারা আমাকে ভালবাসো, তাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ, আমার সমালোচনা করো, তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তুু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলভিত্তি গুলোর উপর যদি কোনো দিন আঘাত আসে, তোমরা যেন সংঘবদ্ধ হয়ে সে আঘাত প্রতিহত করো। নইলে এই যে দীর্ঘকাল ধরে বাঙালীর এত রক্তপাত, এত আত্মত্যাগ, সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।'
তিনি তার কক্ষের দরজা পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, 'ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তুু একটা কথা জেনে রেখ, ওরা আমাকে হত্যা করে বিস্মৃতির অন্ধকারে পাঠাতে পারে, তাতে আমার যুদ্ধ বন্ধ হবে না। আওয়ামী লীগ পথভ্রষ্ট হলেও এ যুদ্ধ চলবে। বাংলার মানুষ আমাকে ভুলবে না। আমার হয়ে তারা যুদ্ধ চালাবে। সে যুদ্ধেও আমি নেতৃত্ব দেবো।'
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের এক দুপুরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার এই সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা। তারপর ৩২ নম্বরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আরো একবার দেখা করেছি। বোধ হয় জুলাই মাসের শেষ দিকে লন্ডনে ফিরে এসেছি।
১৫ আগষ্ট সকালে লন্ডনে ঘুম থেকে উঠেই সপরিবারে তাঁর নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর পেয়েছি।.....
("মৃত্যুর পরও শেখ মুজিব কেনো বেঁচে আছেন" আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা।)
বিঃ দ্রঃ আমাদের পোষ্ট গুলো যদি আপনার ভাল লাগে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। তাহলে আর ভাল পোষ্ট নিয়ে হাজির হব।
Please do not enter any spam link in the comment box.